প্রথম রাজধানী
রুশ প্রচারণা যেভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরছে, বাস্তবে মাঠের পরিস্থিতি তার সম্পূর্ণ উল্টো। যুদ্ধের তিন বছরের বেশি সময় পরও ইউক্রেন লড়াইয়ে টিকে আছে শুধু নয় বহু ক্ষেত্রে রাশিয়াকে প্রতিরোধে পরাস্তও করেছে। সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ বলছে, ধীরে ধীরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে ইউক্রেনই এই যুদ্ধে এগিয়ে যাচ্ছে। এই যুদ্ধের শেকড় ২০১৪ সালে, যখন রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে এবং পূর্ব ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা শুরু করে। তবে সর্বাত্মক হামলা শুরু হয় ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল পুরো ইউক্রেনকে দখল করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এর অস্তিত্ব মুছে দেওয়া। প্রথমে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই কিয়েভ দখল হয়ে যাবে। পশ্চিমা শক্তিগুলোও জেলেনস্কিকে নির্বাসিত সরকার গঠনের পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি কিয়েভ ছাড়েননি। তাঁর বিখ্যাত উক্তি আমার দেশ ছাড়ার প্রয়োজন নেই, আমার দরকার গোলাবারুদ।’ এরপরই ইউক্রেনীয় সেনারা পাল্টা লড়াইয়ে বিশ্বকে চমকে দেয়। ২০২২ সালের গ্রীষ্মের শেষে ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণে নামে এবং খারকিভ ও খেরসন অঞ্চলে বড় জয় পায়। তখন থেকে রাশিয়া আর কোনো কৌশলগত শহর দখল করতে পারেনি। বরং ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তারা বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে প্রায় দুই থেকে তিন লাখ সেনা নিহত বা আহত হয়েছে বলে পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অনুমান। রাশিয়া ইউক্রেনের মাত্র শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, যা মূলত সীমান্ত অঞ্চলের একটি সরু অংশ। এই হারে অগ্রসর হলে বাকি ইউক্রেন দখলে রাশিয়ার শত বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য। কৃষ্ণসাগরে যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়ার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র কৌশলে ইউক্রেন একের পর এক রুশ যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করেছে। ব্ল্যাক সি ফ্লিটের ফ্ল্যাগশিপ জাহাজ মস্কোভা ডুবে যাওয়ার পর রাশিয়া বাধ্য হয় তাদের নৌবহর নিরাপদ বন্দরে সরিয়ে নিতে। আকাশযুদ্ধেও রাশিয়া ব্যর্থ। তারা আজও ইউক্রেনের আকাশ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। বরং ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রুশ বিমানঘাঁটি ও জ্বালানি স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইউক্রেনের সাফল্যের অন্যতম কারণ তাদের আত্মনির্ভর লড়াই। ন্যাটো দেশগুলো অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়েছে, তবে কোনো দেশ সরাসরি সৈন্য পাঠায়নি। রাশিয়ার হয়ে কেবল উত্তর কোরিয়ার প্রায় ১০ হাজার সেনা লড়ছে বলে ধারণা করা হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে ইউক্রেনকে উন্নত অস্ত্র দিতে পশ্চিমা দেশগুলো অনিচ্ছুক ছিল। তবু সীমিত সহায়তা নিয়েই ইউক্রেনের সেনারা যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা বিশ্বের সামরিক বিশ্লেষকদের অবাক করেছে। রাশিয়া এখন ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণের মনোবল দুর্বল করার কৌশল নিয়েছে। তাদের প্রচারণায় বলা হচ্ছে, রাশিয়ার জয় অবশ্যম্ভাবী যাতে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে হেরে গেলে ক্ষতি হবে শুধু ইউক্রেনের নয়, বরং গোটা ইউরোপের নিরাপত্তার। যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনকে ‘রুশ জাতির অংশ’ প্রমাণ করা। কিন্তু যুদ্ধের তিন বছরে পুতিনের এই দাবি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আজ ইউক্রেনীয়রা নিজেদের স্বাধীন জাতি হিসেবে আরও ঐক্যবদ্ধ। ইতিহাস বলছে, একটি জাতি কেবল ভূখণ্ড দিয়ে নয়—স্মৃতি, গল্প আর ত্যাগের মাধ্যমে টিকে থাকে। রুশ আগ্রাসন ইউক্রেনের সেই আত্মপরিচয়কে আরও শক্ত করেছে। তাই যুদ্ধ এখনো চললেও রাজনৈতিকভাবে ইউক্রেন ইতিমধ্যেই জিতে গেছে।
যে কারণে রাশিয়া নয়, যুদ্ধে জিতবে ইউক্রেনই

